প্রথমেই যখন শুনলাম নোয়াখালীতে পুলিশ হত্যা মামলায় ৩জন কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তখনই নোয়াখালী জেলার একাধিক সমন্বয়ক, আন্দোলনকারী এবং জেলা পুলিশের সাথে কথা বলেছি ৷
নোয়াখালীর মেইন আন্দোলন হয়েছে মাইজদীতে ৷ সমন্বয়কদের ভাষ্য অনুযায়ী মাইজদীতে গুলি চলেনি ৷ যে ৫জন শহীদ হয়েছেন তারা সোনাইমুড়ী উপজেলার এবং সেখানেই শহিদ হয়েছেন৷
৫ তারিখে হাসিনা সরকারের পতনের পর বিকাল প্রায় ৪টার দিকে সোনাইমুড়ী থেকে বিজয় মিছিল বের হয় ৷ যারা এতোদিন ধরে আন্দোলন করেছে তাদের ঊদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণভাবে তাদের আন্দোলনের ক্ষেত্র মাইজদীতে যাওয়া ৷ এর মধ্যে কিছু অতি উৎসাহী মানুষ সোনাইমুড়ী থানার দিকে অগ্রসর হয়। তারা থানার ভিতরে আওয়ামীলীগ এর নেতাকর্মী আছে এই তথ্যের ভিত্তিতে থানায় প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ মাইক দিয়ে থানার ভিতরে না আসার জন্য ঘোষণা করে। কিন্তু মানুষ তারপরও থানার ভিতরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করে । তখন পুলিশ গুলি ছুড়লে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয় এবং তাদের একজন ওই স্থানেই মারা যায়। এরপর শুরু হয় অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি, হামলা, পাল্টা হামলা। মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে । তখন জনতার ভিতর থেকে কিছু সুযোগসন্ধানী ভিন্ন উদ্দেশ্যের লোক থানার অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করে, পুলিশ এর দিকে গুলি ছুড়ে এবং একজন কস্টেবল কে পিটিয়ে হত্যা করে । এতে মোট দুইজন পুলিশ সদস্য এবং তাদের একজন ড্রাইভার নিহত হয় । কিছু পথচারী, কিশোরও গুলিবিদ্ধ হয় ।
যে ৩জন ছেলেকে গ্রেফতার নিয়ে কথা হচ্ছে তাদেরকে গ্রেফতার করার মূল কারন ছিল তাদের মধ্যে একজন সেদিনের লুট করা অবৈধ অস্ত্র সহ টিকটকে পোস্ট দেয় ভাব নেওয়ার জন্য ৷ সেই ছবি দেখে স্থানীয় জনতা সহ অনেকেই পুলিশকে অবহিত করে এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয় ৷ জিজ্ঞাসাবাদে সেই ছেলে আরো দুজনের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করে এবং এক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার বিভিন্ন এভিডেন্স তাদের কথায় ও ফোন ম্যাসেজিংয়ে পায় ৷
এখন পর্যন্ত নোয়াখালীতে ২৯টি লুটকৃত অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি ৷ যেগুলোর মধ্যে রয়েছে চায়না রাইফেল, পিস্তল, শর্টগান ইত্যাদি ৷ যেগুলো নিয়ে জনমানুষের মধ্যেও ভীতি আছে৷
উল্লেখ্য একাধিক স্থানীয় আন্দোলনকারী ও সমন্বয়কের মাধ্যমে জানতে পারি তারা সমন্বয়ক তো নয়ই বরং রেগুলার আন্দোলনকারীও ছিল না ৷ ওই ছেলেগুলোকে চেনে এমন এলাকার সমবয়সীরা সেটা নিশ্চিত করেছে ৷ তারা স্থানীয় একটি কিশোর গ্যাং ‘বুলেট গ্যাং’ এর সদস্য ৷ তাদের ফেসবুক প্রোফাইল ঘাটলেও নামের সামনে ‘বুলেট’ ট্যাগ দেখা যায় ৷
পাশাপাশি ৫ তারিখের পূর্বে ও পরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের উৎপাত এবং সংশ্লিষ্টতা দেখা যায় ৷
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেউ যদি আন্দোলনকারী বা সমন্বয়কের নাম ভাঙিয়ে কোনো অন্যায় কাজে লিপ্ত হয় তাহলে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যাবে কিনা ? উত্তর হচ্ছে অবশ্যই আনতে হবে ৷ পাশাপাশি বিভিন্ন গুজবে বা তদবিরে কোনো অন্যায়কারী যেন ছাড়া না পায় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে ৷
পরবর্তীতে তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওই ৩জনের মধ্যে ২জনকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে এবং ১জনকে লঘুভাবে জড়িত থাকার কারনে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে ৷
উল্লেখ্য জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র-জনতার বিভিন্ন মামলায় এখন পর্যন্ত নোয়াখালীতে ৮জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে৷
এবার যদি পুলিশের বিষয়ে বলি ৷ অপরাধীদের আপনারা আইনের আওতায় আনবেন অবশ্যই ৷ তবে যে পুলিশ সদস্যরা নিজে অন্যায়ভাবে জুলাই হত্যাযজ্ঞে জড়িত ছিলো তাদেরকেও দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে ৷ যারা ২৪ এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহন করেছে তারা বিপ্লবী সেনা, অভ্যত্থানের নায়ক ৷ তাদের গ্রেফতার করার পূর্বে সারজিস, হাসনাত, নাহিদ, আসিফ সহ বাকিদেরও গ্রেফতার করতে হবে ৷ আন্দোলনে অংশগ্রহনের জন্য তাদেরকে কোনো প্রকার হয়রানি করা যাবেনা ৷ অন্য অপরাধ থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে ৷
এখনো বিভিন্ন থানায় কিছু পুলিশ সদস্যের টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ৷ মিথ্যা মামলায় চাপ প্রয়োগের কথা শোনা যাচ্ছে ৷ এতো রক্তপাত আর জীবনের বিনিময়ের পরও যেসব কালপ্রিটরা এখনো ঘুষ খায় তারা শহিদের রক্তকে কলঙ্কিত করছে ৷ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে ৷
পুলিশের উপর দেশের জনগণ আস্থা রাখতে চায় ৷ তবে সেই আস্থা নিজেদের কাজের মাধ্যমে পুলিশকেই ফিরিয়ে আনতে হবে ৷ বিগত বছরগুলোতে পেশাদারিত্ব ভুলে গিয়ে অনেক পুলিশ সদস্যের দলের হয়ে তোষামদকারী হিসেবে কাজ করার পরিনতি কি হতে পারে কিংবা ‘বাংলাদেশ পুলিশ’ নামক প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদাবোধ কোথায় নিয়ে গিয়েছে সেটা স্পষ্ট দৃশ্যমান ৷
আশাকরি অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে ভবিষ্যতে পুলিশ সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের পরিচয় দিবে এবং প্রত্যাশিত গৌরব ফিরিয়ে আনবে৷